বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক বুলবুল আহমেদ। আজ গুণী এই অভিনেতার ৮৪তম জন্মবার্ষিকী। নন্দিত এ অভিনেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান ‘মহানায়কের গান’ সিজন-২।

আজ বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) এই উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ বড় মেয়ে তিলোত্তমা গেয়ে শোনাবেন তার বাবা অভিনীত ছবির জনপ্রিয় গান। তিলোত্তমা মনে করেন, ‘এই উদ্যোগের মাধ্যমে কেবল বাবার প্রতি শ্রদ্ধা নয়, বরং বাংলাদেশি সংগীতকে সমৃদ্ধ করতে যারা অবদান রেখেছেন-সেসব গুণী গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদেরও স্মরণ করা হবে এই আয়োজনের মাধ্যমে।’

বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা বুলবুল আহমেদের জন্ম ১৯৪১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আগামসি লেনে। বাবা খলিল আহমেদ ও মা মোসলেমা খাতুনের অষ্টম সন্তান তিনি।

ছেলেবেলায় বুলবুল আহমেদের চলচ্চিত্র দেখার শখ ছিল। একটা পর্যায়ে তা নেশার মত হলেও বড় ভাইবোনেরা তাকে ছবি দেখতে নিতেন না। বাবার হাত ধরে প্রেক্ষাগৃহে লরেল হার্ডির ছবি দেখেন। তখন ঢাকার প্যারাডাইস ও ব্রিটানিয়া প্রেক্ষাগৃহে ইংরেজি ছবি দেখানো হত।

বাবার চাকরির সুবাদে বুলবুল আহমেদকে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। যে কারণে তার পড়ালেখার শুরু কলকাতার মুসলিম গার্লস স্কুলে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। দেশ বিভাগের পূর্বে আবার ঢাকায় বদলি হন বাবা। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা কলেজ, নটরডেম কলেজ ফেরিয়ে বুলবুল আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ থেকে এম.এ. পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি ‘ডাকসু’ ও এসএম হল নাটকে অভিনয় করেন।

১৯৬৩ সালে এম.এ. পাশ করার পর রেডিওতেও কাজ করেন তিনি। ‘অনুরোধের আসর’ নামে গানের অনুষ্ঠান দিয়েই ঘোষক হিসেবে নাম লেখান। তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক যা বর্তমানে জনতা ব্যাংক-এ যোগ দেন। দশবছর ব্যাংকার হিসেবে কাজ করার পরও নাটক ছাড়েননি। মঞ্চে ও টেলিভিশনে নাটক করে গেছেন নিয়মিত।

বুলবুল অহমেদ কবিতা আবৃত্তি করতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন চালু হওয়ার পর নিয়মিত নাটকে অভিনয় শুরু করেন। টেলিভিশনে তার প্রথম নাটক আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘পূর্বাভাস’। ‘ইডিয়েট’ নাটকটির জন্যে তিনি দর্শক হৃদয়ে আজও এক দুর্লভ স্থান অধিকার করে আছেন।

১৯৫৮ সালে বুলবুল আহমেদের অভিনয়ের শুরুটা হয় মঞ্চনাটক দিয়ে। সিলেটের এমসি কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষ রক্ষা’ নাটকে মূল চরিত্র ‘গদাই’ নামভূমিকায় অভিনয় করেন। মুম্বাইয়ের দিলীপ কুমার আর কলকাতার উত্তমকুমার এবং নায়িকা মধুবালা, নার্গিস ও সুচিত্রা সেন তার বিশেষ পছন্দের তালিকায় আছেন।

পরে ঢাকায় কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘শ্যামলী শিল্পী সংঘ’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী গঠন করেন। ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। মঞ্চে যেসব নাটকে বুলবুল আহমেদ অভিনয় করেছনে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘কানাকড়ি’, ‘বারো ঘণ্টা’, ‘মানচিত্র’, ‘গোধূলির প্রেম’ ও ‘অ্যালবাম’।

বুলবুল আহমেদের স্ত্রী ফওজিয়া পারভিন ডেইজি। ছেলেবেলা থেকে দুজনে পরিচিত ছিলেন। ভালবাসা থেকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়। তদের এক ছেলে, দুই মেয়ে।

টেলিভিশনে বুলবুল আহমেদের অভিনয়জীবন শুরু হয় তার নাট্যগুরু আবদুল্লাাহ ইউসুফ ইমামের হাত ধরে। অভিনেতা হিসেবে সত্যিকার অর্থে পথচলা শুরু ১৯৬৮ সালে ‘পূর্বাভাস’ নাটকের মধ্য দিয়ে। ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘ইডিয়ট’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘তোমাদের জন্যে ভালোবাসা’, ‘তুমি রবে নীরবে’, ‘টাকায় কি না হয়’, ‘মালঞ্চ’, হৈমন্তী’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘সারাদিন বৃষ্টি’, ‘রূপনগর’, ‘সারাবেলা’ এরকম প্রায় তিনশতাধিকেরও বেশি নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।

পরবর্তীতে জহির রায়হানের উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’-তে অভিনয় করে সবার নজরে আসেন তিনি। ‘কায়েসের’ চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করায় পরবর্তীতে জহির রায়হানের উপন্যাস নিয়ে করা সমস্ত নাটকে তিনি সুযোগ পেতে থাকেন।

বুলবুল আহমেদের নাট্যগুরু আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেই ১৯৭৩ সালে ‘ইয়ে করে বিয়ে’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে রূপালি পর্দায় যাত্রা শুরু। মঞ্চ, রেডিও, টিভি নাটকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে পরিবারের সকলের সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি।
শখের অভিনয়, নেশা থেকে পেশায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। ব্যাংকিং পেশা ছেড়ে দিয়ে অভিনয়ে নেমে পড়েন। সেসময় ‘জীবন নিয়ে জুয়া’ ছবির মধ্য দিয়ে ববিতার সঙ্গে জুটি বেঁধে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে আলমগির কবির পরিচালিত ‘সূর্যকন্যা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জহির রায়হান পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হল- ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘মোহনা’, ‘মহানায়ক’, ‘পুরস্কার’, ‘সোহাগ’, ‘বৌরানী’, ‘ঘর সংসার’, ‘বধু বিদায়’, ‘ছোট মা’, ‘আরাধনা’, ‘সঙ্গিনী’, ‘সময় কথা বলে’, ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’, ‘শেষ উত্তর’, ‘স্বামী’, ‘ওয়াদা’, ‘গাংচিল’, ‘কলমিলতা’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দেবদাস’, ‘ভালো মানুষ’, ‘বদনাম’, ‘দুই জীবন’, ‘দিপু নাম্বার টু’, ‘দি ফাদার’, ‘রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি।

চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন বুলবুল আহমেদ। ‘অঙ্গীকার’, ‘জীবন নিয়ে জুয়া’, ‘ওয়াদা’, ‘ভালোমানুষ’, ‘মহানায়ক’ সিনেমাগুলো প্রযোজনা করেন তিনি। মহানায়ক তাঁর প্রথম একক প্রযোজনা। তার পরিচালিত অন্যতম প্যাকেজ নাটকগুলো হল- ‘মেঘে ঢাকা আকাশ’, ‘তুমি কি সেই তুমি’, ‘একটি প্রেমের জন্য’, ‘মন ছুঁয়ে যায়’, ‘চিরকুট’, ‘অনামিকা’, ‘অন্য মনে’, ‘পলাতক সে’, ‘অকারণে অবেলায়’, ‘বিলেতি বিলাস’, ‘জীবন নদীর জোয়ার ভাটা’, ‘ঝরা পাতা’, ‘কোন গগনের তারা’, ‘ঋতু গৃহ’, ‘বৃষ্টি’, ‘ওরা তিনজন’, ‘ইয়ে নিয়ে বিয়ে’ ইত্যাদি।

অভিনয়, প্রযোজনা এবং পরিচালনার পাশাপাশি উপস্থাপনা, বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশগ্রহণ এমনকি বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণও করেছেন বুলবুল আহমেদ। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের পাশাপাশি কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।

বুলবুল আহমেদের স্ত্রী অভিনেত্রী ডেইজি আহমেদ। এই দম্পতির তিন সন্তান হলেন মেয়ে তাহসিন ফারজানা তিলোত্তমা, ঐন্দ্রিলা আহমেদ এবং ছেলে শুভ।

সকাল নিউজ/এসএফ

সম্পাদক ও প্রকাশক: শিহাব আহমেদ

Sokal News | সকাল নিউজ is a youth-led online news and media portal dedicated to delivering accurate, timely, and impactful news. Driven by a passion for truth and transparency, our mission is “সত্যের আলোয় প্রতিদিন” (“In the light of truth, every day”). Stay connected with us for trustworthy news coverage from a fresh perspective.

প্রধান কার্যালয়:
সকাল নিউজ, ই-১৭/৬, চায়না টাউন, ভিআইপি রোড, নয়াপল্টন, ঢাকা-১০০০

© ২০২৫ সকাল নিউজ. সর্বস্বত্ত সংরক্ষিত Shihab Group.
Exit mobile version