আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচিত সরকার আগামী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত অপরাধ এবং গুম-খুনসহ আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অগ্রসর হবে কি না, সেজন্য আমাদের তাড়াহুড়া করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এর ফলে যতটা নিখুঁতভাবে এই কাজটা করা দরকার ছিল, তা কিন্তু আমি করতে পারব না। অনেক বেশি রাশ (তাড়াহুড়া) করতে হচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তাজুল ইসলাম এ কথা বলেন। আজ শনিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সরকারের গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
এ সময় চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘নতুন বাস্তবতায় আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে, এই চিন্তাগুলো যদি আমাদের করতে না হতো, তাহলে খুব ভালো হতো। সেটা হচ্ছে যে ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশন (নির্বাচন) হবে, নির্বাচিত সরকার আসবে, তারা যদি এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অগ্রসর না হয়। সে কারণে অনেক বেশি রাশ করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং আওয়ামী লীগের সরকারের সময় সংঘটিত গুম-খুনসহ যেসব ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়েছে, সেসবের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিতে না পারলে তা বড় ধরনের ব্যর্থতা হবে।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গুমের যে বিস্তৃতি, এই জায়গায় এই বিচারগুলো করার জন্য যে পরিমাণ সময় দরকার, এতটুকু সময় কিন্তু গুম কমিশনও পাচ্ছে না, আমরাও পাচ্ছি না। যদি আমরা অন্তত চার্জশিটগুলো (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দিয়ে যেতে না পারি, তাহলে এটা বড় ধরনের ব্যর্থতা হবে।
এসময় তিনি আরও বলেন, ‘১৮০০ প্লাস গুমের ঘটনা, এগুলোর যে শাখা–প্রশাখা আছে, এগুলো কি নিখুঁতভাবে কয়েক মাসে বের করা সম্ভব? প্র্যাকটিক্যালি তো সম্ভব না। কিন্তু এই অসম্ভব কাজ আমাদের করতে হচ্ছে এই আশঙ্কা থেকে যে পরের গভর্নমেন্ট যদি কিছু না করে। তাহলে পরের গভর্নমেন্টে যারা আসবেন, তাদের প্রত্যেককে এটা বুঝতে হবে যে কেন তাদের এই জিনিসটা কন্টিনিউ করতে হবে। সেটা যদি তারা বুঝতে না পারেন, এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য জাতির জন্য আর কিছুই হবে না।’
রাজনৈতিক দলগুলোকে এই অনুষ্ঠানে আলোচিত কথাগুলো শোনানো জরুরি বলে মনে করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তাদের (রাজনৈতিক দল) বুঝতে হবে বাংলাদেশে কী ঘটে গেছে। এটার (গুম ও হত্যাকাণ্ড) বিচার না হলে বাংলাদেশে তা আবার ফিরে আসতে পারে। এই জিনিসটা তাদের জানানো জরুরি। কারণ, এই উপদেষ্টা পরিষদের মেয়াদ আগামী ফেব্রুয়ারির পরে শেষ হবে। তারপর তারা (রাজনৈতিক দল) দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তারা যদি এর গ্রেভিটি বুঝতে না পারেন, এটার ব্যাপারে তারা যদি দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে বাংলাদেশ যে কারণে এত রক্ত দিয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবর্তন আনল, সেই অর্জনটা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অপরাধীর পরিচয় শুধু সে একজন অপরাধী। তার পরিচয় হতে পারে না যে সে কত বড় সংস্থায়, কত বড় অফিসার, কত বড় কর্তা। যারা অপরাধী, তাদের দায় কারোরই গ্রহণ করা উচিত নয়। আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং সভ্যতা ও জাতিসত্তাকে রক্ষা করতে হলে অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতেই হবে।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যারা আজ তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বা করবেন, তাদের মনে রাখতে হবে, তারাও একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেই পারেন। এ ধরনের অপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা করাটাও কিন্তু এই অপরাধের বিচারকে বিঘ্নিত করার একটা চেষ্টা, যেটাও একটা অপরাধ।’
গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান প্রমুখ।
সকাল নিউজ/এসএফ