বসভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। একসময় মানুষ আগুন জ্বালানো, শিকার করা কিংবা চাকা তৈরি করাকে জীবনের বড় আবিষ্কার ভেবেছিল। পরে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট- এসব বিপ্লব বদলে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। আজ আমরা এমন এক সময় দাঁড়িয়ে আছি, যখন প্রযুক্তি শুধু আমাদের জীবন সহজ করছে না, বরং আমাদের ভবিষ্যৎকেও নতুন আকারে গড়ে তুলছে।
বর্তমান যুগে সবচেয়ে আলোচিত প্রযুক্তি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একসময় সিনেমার পর্দায় রোবট কিংবা মেশিনের বুদ্ধিমত্তা দেখে বিস্মিত হত মানুষ। আজ তা বাস্তবে নেমে এসেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ দ্রুত শনাক্তকরণ, রোগীর জন্য আলাদা চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি- সবই করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুযায়ী আলাদা পাঠ্যবস্তু তৈরি সম্ভব হচ্ছে। ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং, কৃষি, পরিবহন- কোথায় নেই এআইয়ের ব্যবহার!
কিন্তু এই অগ্রগতি যেমন আশাব্যঞ্জক, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও। অনেকে আশঙ্কা করছেন, প্রচুর মানুষ চাকরি হারাতে পারে। আবার ভুয়া তথ্য তৈরি, গোপনীয়তার লঙ্ঘন এবং সাইবার অপরাধের মতো ক্ষেত্রেও এর অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এআইয়ের ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমরা আজ যে কম্পিউটার ব্যবহার করি, তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জটিল হিসাব বা গবেষণার ক্ষেত্রে সময় লাগে অনেক। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছে। এটি কেবল তথ্য প্রক্রিয়া করে না; একসঙ্গে বহু সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করতে পারে। ফলে যে গবেষণায় আজকের সুপার কম্পিউটারের কয়েক বছর লাগতে পারে, তা কোয়ান্টাম কম্পিউটার কয়েক মিনিটেই করে ফেলতে সক্ষম।
ওষুধ আবিষ্কার, মহামারি প্রতিরোধ, জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাস, এমনকি আর্থিক খাতের জটিল হিসাব- সব ক্ষেত্রেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। তবে এর ঝুঁকিও কম নয়। বর্তমানের এনক্রিপশন ব্যবস্থা এটি সহজেই ভেঙে ফেলতে পারে, যা বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মানুষের দৃষ্টি এখন সীমাহীন মহাকাশের দিকে। চাঁদে বা মঙ্গলে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলার স্বপ্ন অনেকটাই বাস্তবের পথে হাঁটছে। নাসা, ইলন মাস্কের স্পেসএক্সসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান মহাশূন্যে বসতি গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। কল্পনা করুন, একদিন হয়তো মানুষ পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহে কৃষিকাজ করবে, পরিবার গড়ে তুলবে, আর সেখানেই নতুন সভ্যতা শুরু হবে।
তবে এটি যতটা রোমাঞ্চকর, ততটাই কঠিন। পৃথিবীর বাইরে অক্সিজেন, পানি, খাবার, মাধ্যাকর্ষণ- সবকিছুর অভাব আছে। মানুষের শরীর দীর্ঘ সময় ভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা এখনো বড় প্রশ্ন। তবু বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, আগামী শতাব্দীর মধ্যেই প্রথম স্পেস কলোনি গড়ে উঠতে পারে।
প্রতিটি প্রযুক্তিই যেমন উন্নতির প্রতীক, তেমনি অযাচিত ব্যবহারে ভয়ঙ্কর হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে তা মানুষকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার যেমন বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটাবে, তেমনি সাইবার দুনিয়ায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। আবার মহাশূন্যে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পৃথিবীর পরিবেশ ও অর্থনীতি কীভাবে প্রভাবিত হবে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।
এককথায় বলা যায়, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি শুধু আমাদের জীবন সহজ করবে না, বরং মানবসভ্যতার দিকনির্দেশও বদলে দেবে। তবে সেই অগ্রগতি যেন আমাদের জন্য হুমকি না হয়ে দাঁড়ায়, সেজন্য প্রয়োজন দায়িত্বশীল ব্যবহার, সঠিক নীতিমালা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
সকাল নিউজ/এসএফ