কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে কেবল লুটেরা মাফিয়া শ্রেণি। যাদের হাতে কোটি কোটি টাকা, তারাই নির্বাচনের কথা বলছে। তরুণ ছাত্ররাও বিভ্রান্ত হয়েছে– তারা মনে করছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে বদলানো সম্ভব। কিন্তু নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা পরিত্যাগ করে প্রকৃত অর্থে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।’
শুক্রবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে বেসরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস (দায়রা) আয়োজিত দুই দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘বেঙ্গল ডেলটা কনফারেন্স’–এর এক অধিবেশনে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের তাৎপর্য অস্বীকার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল চেতনা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’ তাঁর ভাষ্য, ‘রাষ্ট্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি– প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নতুনত্ব নেই, অর্থনৈতিকভাবে ভাবনার কোনো দিগন্তও উন্মোচিত হয়নি।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশের ভেতরকার কোনো ঘটনা নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্ব রাজনীতিতেও এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। এই অভ্যুত্থান দেখিয়েছে যে পুরোনো রাষ্ট্রধারণা দিয়ে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করা সম্ভব নয়। বাঙালি বা ইসলামী জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ ধারণা ছেড়ে রাজনৈতিক কমিউনিটি গঠনের শিক্ষা নিতে হবে, যেখানে ভিন্ন মত, পথ ও বিশ্বাসের মানুষ একত্রে থাকতে পারবেন। তাঁর মতে, এই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর ধারণাই জাতিবাদী বিভাজন থেকে মুক্তি এনে দিতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ অভ্যুত্থান শুধু শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বা তাঁর রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ছিল না; একইসঙ্গে এটি ছিল দিল্লির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও। জনগণ দলীয় পরিচয় ভুলে গিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেটিই গণ–অভ্যুত্থানকে শক্তিশালী করেছে। তবে পরবর্তী সময়ে সবাই আবার দলীয় বিভাজনে ফিরে গেছে– বামরা ইসলামপন্থীদের আক্রমণ করছে, ইসলামপন্থীরা বামদের। এমনকি ইসলামিক শক্তি যখন সামান্য ক্ষমতা পেয়েছে, তখন তারা মাজার ভাঙা শুরু করেছে– যা তাদেরই আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ। এসব পরিচয়বাদী রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে উঠতে দিচ্ছে না।’
ফরহাদ মজহার সতর্ক করে বলেন, ‘অনেকেই ভেবে নিয়েছেন শেখ হাসিনা ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় দেশে শান্তি নেমে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে তিনি এখনো আছেন– আছেন তাঁর সংবিধান, আইন, আদালত, পুলিশ ও সেনাবাহিনী। এ কারণেই পরিবর্তনের ভ্রান্ত ধারণা মানুষকে বিপথে নিচ্ছে।’
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে—যেন তারা শুধু বিশৃঙ্খলা চায়। অথচ ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে যে নতুন রাজনীতির জন্ম হয়েছে, সেটি গাঁথুনিক রাজনীতি; যা পুরোনো সাম্রাজ্যবাদ ও অভ্যন্তরীণ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লড়াই।
অধিবেশনে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, এরশাদ সরকার ও শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে একটি সাদৃশ্য রয়েছে। দুজনই ভারতীয় প্রভাবের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশকে শাসন করেছেন। সে কারণেই উভয় সময়েই গণ–অভ্যুত্থান ভারতবিরোধী চরিত্র ধারণ করেছে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রুনেই দারুসসালামের সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবাল।
সকাল নিউজ/এসএফ