ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন দপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্যে সেই প্রমাণই মিলে। শুধু বুধবার (২৭ আগস্ট) এক দিনে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছেন ৭৪১ জন পর্যটক, আর বহির্গমন করেছেন ৮২৩ জন। অর্থাৎ, এদিনে ইমিগ্রেশন দিয়ে চলাচল করেছেন মোট ১ হাজার ৫৬৪ যাত্রী।
ভারতের পর্যটন খাতে বাংলাদেশিদের অবদান নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি লোকসভায় বিদেশি পর্যটন নিয়ে আলোচনায় কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে ভারতে আসা বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে শীর্ষ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, জার্মানি, ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ সব সময়ই অন্যতম শীর্ষ অবস্থানে থেকেছে।
মন্ত্রী আরও জানান, ২০২০ ও ২০২৩ সালে বিদেশি পর্যটক আগমনের নিরিখে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। তবে ২০২১, ২০২২ ও ২০২৪ সালে সেই অবস্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাও ভারতের পর্যটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কলকাতার নিউমার্কেটের হোটেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ থেকে প্রায় সমানসংখ্যক পর্যটক ভারতে এলেও রাজস্বের দিক থেকে এগিয়ে আছেন বাংলাদেশিরা। কলকাতার নিউমার্কেট কিংবা বড়বাজারের ব্যবসা অনেকটাই নির্ভরশীল বাংলাদেশি ক্রেতাদের উপর। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, বাংলাদেশি ক্রেতারা না এলে কলকাতার বাণিজ্য অঙ্গন অচল হয়ে পড়বে। তাই তারা আশা করছেন, ভারত-বাংলাদেশ দ্রুত বসে ভিসাজনিত জটিলতার সমাধান করবে। কারণ ভিসা জটিলতার কারণে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশি পর্যটকদের ভারতে আগমন শুধু ভ্রমণ বা কেনাকাটায় সীমাবদ্ধ নয়। চিকিৎসার জন্যও তারা বিপুল হারে ভারতমুখী। কলকাতার মুকুন্দপুর থেকে শুরু করে দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ কিংবা কেরালার নামকরা হাসপাতালগুলো মূলত বাংলাদেশি রোগী ও তাদের স্বজনদের উপর নির্ভরশীল। পর্যটন খাতের সঙ্গে এভাবেই মিশে গেছে চিকিৎসা খাত, যা ‘মেডিকেল ট্যুরিজম’ নামে পরিচিত।
গ্লোবাল ট্যুরিজম সংস্থার কর্মকর্তা উপাসনা ভট্টাচার্যের ভাষায়, “বাংলাদেশি পর্যটকরা মূলত দুটি কারণে ভারতে আসেন- ভ্রমণ ও চিকিৎসা। চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের পরিবার কেনাকাটা ও ঘোরাঘুরি করেন। এতে যেমন পর্যটন খাত লাভবান হয়, তেমনি ভারত সরকারও উল্লেখযোগ্য রাজস্ব পায়।” তিনি আরও জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ভিসাজনিত জটিলতা কিছুটা শিথিল হওয়ায় পর্যটকের সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করেছে।
তবে সব কিছু এতটা সহজ নয়। গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক বড় রকমের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে। জরুরি চিকিৎসা ছাড়া ভারত বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটন ভিসা বন্ধ রাখে। এর প্রভাব পড়ে ভারতের ব্যবসা ও পর্যটন খাতে। যদিও সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য মেডিকেল ভিসার সংখ্যা বাড়িয়েছে, যা ১০ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, ব্যাঙ্গালোর ও দিল্লির ব্যবসায়ী ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে আশার আলো দেখতে শুরু করেছে।
এখানে খরচও বেড়েছে। ভারতীয় ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার ও বাংলাদেশের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, নতুন ভিসা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা, যা আগে ছিল ৮২৪ টাকা। পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যদি ভারত পর্যটন ভিসা আরও সহজ করে, তাহলে বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়তে পারে।
যদিও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ভারত সফরকারী বাংলাদেশির সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। এ কারণে অনেকেই বিকল্প খুঁজছেন। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন বাংলাদেশিদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠছে। বিশেষ করে চিকিৎসা ও অবকাশ যাপন- এই দুই খাতে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে।
তবু ভারত যে বাংলাদেশিদের জন্য প্রধান আকর্ষণ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যয়, ভ্রমণের স্বাচ্ছন্দ্য, ভাষাগত সাদৃশ্য আর ঐতিহাসিক সংযোগ- সব মিলিয়ে ভারত এখনও বাংলাদেশের পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা। তবে এই আস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে দুই দেশের সরকারকেই বসতে হবে টেবিলে, দূর করতে হবে ভিসার জটিলতা। নাহলে পর্যটন ও ব্যবসায় যে সেতুবন্ধন গড়ে উঠেছে, তা ভেঙে পড়তে দেরি হবে না।
সকাল নিউজ/এসএফ