গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর থেকেই বিগত আমলের মতোই একটি অশুভ শক্তির সর্বত্র চাঁদাবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস, খুনোখুনি ও মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ) সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘এই অশুভ শক্তিকে দমন করতে সরকার ব্যর্থ হলে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে, যা কারও কাম্য নয়।’
গণফোরামের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় ড. কামাল এ কথা বলেন।
সভায় তাঁর পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। লিখিত বক্তব্যে ড. কামাল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রহীনতা ও নিপীড়নমূলক এক স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে আইনের শাসন, ভোটাধিকার, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ অবাধে লুটপাট, অর্থপাচার, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে দেশ শাসনের কারণে দেশে ভয়াবহ সংকট ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। এর ফলেই চব্বিশের জুলাই ছাত্র-জনতার এক অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনরোষে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়।’
গণফোরাম প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হলেও বাস্তবে মানুষ আত্মমর্যাদা ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। চব্বিশের জুলাইয়ে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কোনো অশুভ শক্তি বা ষড়যন্ত্র যেন এই রক্তস্নাত বিজয় ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিগত সরকার দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমূলে ধ্বংস করে রেখে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক উত্তরণ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব।’
আলোচনা সভায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আজকে একটি গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করছে, নির্বাচন যাতে না হয়। নির্বাচন বানচাল করে এই অনির্বাচিত সরকারে তারা অনুপ্রবেশ করে বসে আছে। সেখানে তাদের উপস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য এই ষড়যন্ত্র করছে। এটাকে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কার না করে নির্বাচন দেবে না, সংস্কার করার জন্য যুগ যুগ বসে থাকবে, এটা হতে পারে না। এসব বাহানা দিয়ে কোনো লাভ নেই। এটা কোনো বিপ্লবী সরকার নয়, কোনো নিয়মিত সরকার নয়; এটা হলো অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের প্রধান কাজ বিগত সরকারের অপকর্মের বিচার এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া।’
আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সাতচল্লিশকে মনে রাখতে হবে, চুয়ান্নকে অস্বীকার করা যাবে না। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন বা উনসত্তরকে ভুলে যাওয়া যাবে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেউ ভান করে ভুলতে চাইলে সেটা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপস্থিত থেকেও রাজনৈতিক সহিংসতা ঠেকাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের সরকার মাত্র তিন মাসে সবকিছু ঠিক রেখে একটি নির্বাচন দিয়েছিল। আর এখন এক বছর পার হলেও নির্বাচন কমিশন সময়সূচি ঘোষণা করতে পারেনি।’
আলোচনা সভায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান বলেন, ‘অতীতে আমরা যে অতি নিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচার দেখেছি, এখন তার জায়গায় চলছে অনিয়ন্ত্রিত স্বেচ্ছাচার। আগে এক গোষ্ঠীর লুটপাট ছিল, এখন চলছে বহু গোষ্ঠীর লুটপাট। আগে ছিল ফ্যাসিবাদী নিষ্ঠুরতা, এখন মব হিংস্রতা দেখছি। আগে কথিত আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসা দেখেছি, এখন মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার ও কালিমা লেপনের কার্যক্রম লক্ষ্য করছি।’
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ।
সকাল নিউজ/এসএফ

